শাপমুক্তি
-পার্থসারথি ঘোষাল
তথ্যমিত্র কেন্দ্রের বাইরে সেদিন রূপেনের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো। রূপেন আমাদের কলেজের সবচেয়ে সেরা ছাত্র ছিলো। বর্তমানে ও থাকে গোয়ায়, গোয়ার সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে ফিজিক্সের অধ্যাপক। কসবায় ওর নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে যেখানে বর্তমানে ওর শালা অমলেশ সপরিবারে বাস করছে, অমলেশ একটা বেসরকারি কোম্পানির অডিট সেকশনে কাজ করে। পুজোর ছুটি কাটাতে কালীপুরে এসেছে রূপেন সস্ত্রীক। কালীপুরে ওদের সাবেকী বিশাল দোতালা বাড়ি, বৈঠকখানা, দেউড়ি ও গাড়ি বারান্দা ওদেরই কোনো এক পুর্বপুরুষ নাকি হেস্টিংস সাহেবের খুব নেক নজরে এসেছিলেন। ওদের সাতপুরুষের জমিদারী ছিলো এ তল্লাটে- এখন অবশ্য তার চিহ্নমাত্র নাই। তবুও পোষাকে আষাকে সেই জমিদারী মেজাজের রেশটুকু যেন রয়ে গেছে।চৌধুরী বংশের কুলপ্রদীপ হলো এই রূপেন।
আমি প্রথমে রূপেনকে ঠিক চিনতে পারিনি, কারণ আজ থেকে প্রায় পাঁচবছর আগে বর্ধমানে দেখেছিলাম ওকে। তখন ওর মুখে কোনো দাড়িটাড়ি ছিলনা তাছাড়া স্বাস্থ্যও ভালো ছিলো তখন- তাই মুখটা ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম রাস্তার ওপারে মেছোবাজারের দিকে। রূপেনই এসে আমার কাঁধে হাত রেখে বললো, “কিরে বাদল, তুই আমাকে চিনতে পারলিনা মনে হচ্ছে! দেখেই অমন করে মুখটা ঘুরিয়ে নিলি কেন?”
আমি আমতা আমতা করে বললাম,”ক-ক-ই–ই-না–না-তো!”
রূপেন বললো, “হয় আমাকে তুই চিনতে পারিসনি, না হয় চিনেও চিনতে পারছিস্ না–কি রে? কোনটা?”
আমি গলায় একটা দৃঢ় সুর এনে বললাম, “তোর প্রথম অনুমানটাই সত্যি, অর্থাৎ তোকে আমি ঠিক চিনতে পারিনি ভাই। এই পাঁচবছরে তোর যে এতখানি পরিবর্তন তা যেন ভাবাই য়ায় না, তোর চেহারায় একটা আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে কোথাও। তোর স্বাস্থ্যেরও অনেক অবনতি হয়েছে বন্ধু।”
রূপেন বললো, “তুই ঠিকই ধরেছিস্ ভাই?আজ থেকে বছর তিনেক আগে একটা ঘটনার পর থেকে আমি শারীরিক ও মানসিক ভাবে প্রচণ্ড টেন্সড্ আছি, তারই সুস্পষ্ট প্রভাব পড়েছে আমার শরীরে ও মনে। যাইহোক, আমার কথা এখন থাক- তোর খবর কি? তূই এখন কি করছিস ?”
আমি বললাম, “আমার স্টুডিও ও জোতিষীগিরি নিয়েই বেশ কেটে যাচ্ছে।পেপার খুললেই বুঝতে পারবি আমার জ্যোতিষবিদ্যার প্রসার এখন কেমন!”
রূপেন হো হো করে হেসে উঠে বললো,”বাজারে বেশ ভালোই নাম করেছিস তাহলে! কালেজে তুই তো আমাদের “মুশকিল আসান দাদা” ছিলি- তাই এখন এহেন জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা তারই পরিপূরক বলতে হবে! ঠিকই আছে,চালিয়ে যা।তবে আঁকাটা যেন ছাড়িস না। কলেজে নবীন বরণের দিন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুরারী বসু যখন তোকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলো তখনই তোর প্রতিভার আঁচ পেয়েছিলাম।”
কলেজ লাইফে আমার নাম ছিলো “মুশকিল আসান দাদা” অর্থাৎ বন্ধু মহলে কারও কোনো অসুবিধা হলেই আমি বাৎলে দিতাম সমাধানের পথ।এই রূপেনেরই কত সমস্যার সমাধান করে দিয়েছি; তাই নিজের সেই অতীত ব্যতিক্রমী গুণের কথা স্মরণ করতেই একটা অবাঞ্ছিত কৌতুহল আমাকে যেন পেয়ে বসলো। আমি আবার রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কি যেন একটা ঘটনার কথা বলছিলি, যার জন্য তোর শারীরিক ও মানসিক ভাবে এতখানি পরিবর্তন?”
রূপেন বললো, “আজ এখানে বলা সম্ভব নয়, একদিন আমার বাড়িতে আয় ওখানেই সব খুলে বলবো তোকে। এই রোববারই চলে আয় না সময় করে “আমি তার কথায় সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলাম।
একদিন রবিবার প্রায় সন্ধ্যার সময় রূপেনের বাড়িতে গিয়ে হাজির হলাম। আজকাল কালীপুরের এই বাগান পাড়ায় লোকজন খুব একটা আসেনা। তার অবশ্য একটা কারণও আছে। কারণটা হলো এ পাড়ার চৌধুরীবংশে একমাত্র রূপেন ছাড়া আর কোনো শরিক নেই, হরনাথ চৌধুরীর একমাত্র সন্তান হলো এই রূপেন। হরনাথ চৌধুরী বা তাঁর স্ত্রী কেউই আজ আর বেঁচে নেই। আর মল্লিকরা বা মজুমদাররা কেউ আর এ গ্রামে থাকে না। তারা হয় কেউ প্রবাসে কিম্বা ভারতবর্ষের অন্যান্য শহরে উচ্চ সরকারী পদে আসীন এবং সেখানেই পরিবার পরিজন নিয়ে সেটেল্ড হয়ে গেছে।তাই বাড়িগুলো জনহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেবলমাত্র মাত্র বাগান পাড়ার কঙ্কালের মতো, প্রাণহীন একটা ভৌতিক অস্তিত্ব নিয়ে।
বাড়ির গেট পেরিয়ে গাড়ি বারান্দার কাছে আসতেই চোখ পড়লো সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা চকচকে নীল রঙের হাউনদাই, এটাই রূপেনের নতুন প্রাইভেট কার মনে হয়! এবার চোখ পড়লো দোতালার ব্যালকনির দিকে, মনে হলো কোনো মহিলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণা তৃতীয়ার চা়ঁদের শোভা দেখছে।কিছুক্ষণ পরেই সেখানে এক পুরুষের আভির্ভাব হলো এবং সেই পুরুষ মানুষটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “কিরে বাদল?আয় আয় ভেতরে আয়।”
আমি বুঝতে পারলাম যে ঐ পুরুষটি হলো রূপেন ও মহিলাটি সম্ভবতঃ তার স্ত্রী। আমি সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় উঠতেই রূপেন এসে হাজির হলো।
আমাকে সঙ্গে করে ভেতরে নিয়ে গেলো।একটা লম্বা একটানা বারান্দা পেরোতে পেরোতে একতালার বন্ধ কক্ষগুলো নজরে পড়ছিলো। কতদিন যে তালা বন্ধ তা অনুমান করা প্রায় অসম্ভব, কারণ তালাগুলোতে মরচে ধরেছে। সাবেকী আমলের জমিদারবাড়ি। বাড়িটার চারদিকেই বড় বড় থামওয়ালা বারান্দা। সামনের একটানা লম্বা বারন্দার শেষপ্রান্তে দোতালায় ওঠার সিঁড়ি, আমি ও রূপেন দু’জনেই কথা বলতে বলতে দোতালায় উঠে গেলাম, দোতালার ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা দু’জনেই।
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বাগান পাড়ার মোটামুটি সামগ্রিক অংশই নজর আসছে।এখানে চারদিকে একটা অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতার অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম বাগান পাড়ায় ঢোকার পর থেকেই। তাছাড়া কৃষ্ণা তৃতীয়ার জ্যোৎস্নায় চারদিকটা যেন মূহুর্তে মুহুর্তে মোহময়ী হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ আমরা দু’জনেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।তারপর হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো রূপেন,”চল,চল ভেতরে চল। আর দেখে কি করবি! দেখার বিশেষ কিছু নেই, সেই ধ্যাড়ধেড়ে কাশীপুরের চৌধুরী পাড়া।”
আমিও আর কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম ওর সঙ্গে।
ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে সোফার উপর বসে পড়লাম, কারণ অনেকটা রাস্তা হেঁটে এসেছি।এবার আমার চোখ পড়লো ড্রয়িংরুমের চারদিকে টাঙানো নারী ও পুরুষের তৈলচিত্র গুলির উপর, রূপেন একে একে সকলেরই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলো আমার কাছে- অর্থাৎ এইসব তৈলচিত্র হলো এই বংশের পুর্বপুরুষগণের যাদের সস্ত্রীক তৈলচিত্র বানানো হয়েছিলো একসময়। এবার রূপেন সামনের একটা সোফায় আরাম করে বসে পড়ে বললো, “কি কেমন দেখলি? এটাকে আমি ড্রয়িং রুম বানিয়ে নিয়েছি। এটা আসলে ছিলো আমার পিতামহ দেবের সভাকক্ষ। সরকারী আমলা থেকে আরম্ভ করে নায়েব, গোমস্তা সবাই এখানে বসেই আলাপ আলোচনা সারতো।অর্থাৎ তাঁর সময় পর্যন্ত জমিদারীর ক্ষীণ আবেশটুকু অস্তিত্বের লড়াইয়ে কোনো রকমে টিকে ছিলো আরকি!”
আমি গম্ভীর ভাবে বললাম,”তৈলচিত্রগুলো একদম নিখুঁত হয়ে আছে এখনো। সত্যিই তুই বিরাট অভিজাত বংশের সন্তান- তোর দেহে বইছে জমিদারী রক্ত, তা তোর কথায় বার্তায় বেশ স্পষ্ট।”
রূপেন হো হো করে হেসে উঠলো একবার তারপর বললো,”নাম কে বাস্তে আভিজাত্যের আর কিছুমাত্র চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। এখন আমার নিজস্ব যা কিছু দেখছিস তা এক নূতন অধ্যায়ের নিদর্শন।”
চৌধুরী বংশের অনেক ইতিহাসই শুনলাম রূপেনের মুখ থেকে। শুনে আমার খুব রহস্যময় মনে হলো। ইতিমধ্যে এক ভদ্রমহিলা চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকলো, রূপেন বললো, “এর সঙ্গে তো তোর পরিচয়ই হয়নি বোধহয়, এ হচ্ছে আমার স্ত্রী রোহিনী।” এবার রোহিনীর দিকে মুখ ফিরিয়ে রূপেন বললো, “আর রোহিনী,এ হচ্ছে আমার কালেজমেট বাদল সেন, বিখ্যাত আঁকিয়ে কাম জ্যোতিষী।”
জ্যোতিষী কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে রোহিনীর চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভ্রুকুটিকুটিল ভাব ক্রমশঃ স্পষ্ট হতে দেখলাম।
রোহিনী দেবী একটু মুচকি হেসে বললেন,”তা বেশ তো,খারাপ কি! এখন তো জ্যোতিষীদের রমরমা বাজার- কি ঠিক বলিনি বাদল বাবু?” আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম রোহিনীদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে। কারণ সে একজন তরুণী অথচ চোখে মুখে যেন সেই তারুণ্যের লেশমাত্র নেই, সে যেন বন্দিনী এক প্রাগৈতিহাসিক জরার অলৌকিক খাঁচায়। রোহিনীদেবীর মুখ যেন বিবর্ণ-পান্ডুর! খুব একটা স্বাভাবিক বলে আদৌ মনে হচ্ছিল না আমার। তার পায়ের মাংসল অংশের ভেতর থেকে যেন আবছা একটা কঙ্কালসার পায়ের ছবি অস্পষ্ট হলেও খুব নজর করে দেখলে বোঝা যায়। আমার ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় যেন সজাগ হয়ে উঠতে চাইছে।
রোহিনী দেবীর ঐ ধরণের অকস্মাৎ প্রশ্নে আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে বললাম, “হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন, তবে সব জ্যোতিষী এক ক্লাসের নন গুণগত তারতম্যের কথাটাও মাথায় রাখতে হবে।” রোহিনী দেবী আবার সেই মুচকি হেসে বললেন,”ঠিক আছে, আপনারা দুইবন্ধু গল্প করুন, আমি রাঁধুনি দিদিকে একটু গাইড করবো, কারণ এ বাড়িতে আপনি আজ প্রথম এসেছেন ত্রুটি হলে তো চলবে না।” কথাটা বলেই রোহিনীদেবী দরজার দিকে পা বাড়ালেন আর ঠিক তখনই আর একটা অদ্ভুত বিষয় আমার চোখে পড়লো। দেখলাম রোহিনীদেবীর সারাগায়ে একটা অশুভছায়া যেন কুয়াশার মতো লেপটে আছে। আমি রোহিনীদেবীর গমনপথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম। সারাঘরটা যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে।
হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে রূপেন বললো, “কি রে কি দেখছিস্ অমন করে ওদিকে চেয়ে?”
আমি বললাম, “কই কিছু না তো।” আমি সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা একেবারেই চেপে গেলাম রূপেনের কাছে।
রূপেন এবার বলতে লাগলো, “শোন তোকে যে জন্য এখানে ডেকেছি- আজ থেকে প্রায় বছর তিনেক আগে পুজার ছুটিতেই হবে! রোহিনী আর আমি পুজার ছুটি কাটাতে এখানে এসেছিলাম। আগেও ওকে এখানে নিয়ে এসেছি বার কয়েক, কিন্তু সেইবারেই ঘটলো সেই ভয়ংকর ঘটনাটা। এই রুমটার পাশেই অর্থাৎ বেডরুমে আমি এবং রোহিনী রাত্রে একটু লুডো খেলতে বসেছি। খেলাটা বেশ জমে উঠেছে এমন সময় বেডরুমের জানালার বাইরে রক্তচন্দনের গাছগুলোর মাথায় একটা দমকা বাতাস এসে ধাক্কা দিয়ে জানালার পাল্লা খুলে ঢুকে পড়লো ভেতরে, সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং। সঙ্গে সঙ্গে বাইরে আর বাতাসের কোনো অস্তিত্বই টের পাওয়া গেলো না, পাঁচ দশ মিনিট পর আবার রুমের লাইট জ্বলে উঠলো, অর্থাৎ কারেন্ট এলো।আমাদের খেলাও গেলো থেমে। খাওয়া দাওয়া সেরে যথারীতি শুয়ে আছি দু’জনেই। লোডশেডিং হলো এবার কিন্তু আর তাড়াতাড়ি কারেন্ট এলো না। বাধ্য হয়ে চার্জার লাইটটা জ্বালালাম, রোহিনী ততক্ষণে বেশ ঘুমিয়ে পড়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজায় একটা আন্দোলন লক্ষ্য করলাম এবং সেই সঙ্গে একটা খস্ খস আওয়াজ।ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে আমি আবার শুয়ে পড়লাম এবং কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা বলতে পারবনা। হঠাৎ কিছু একটা লোমশ জাতীয় জিনিসের স্পর্শ অনুভব করতেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। তাছাড়া চিরদিনই ঘুমটা আমার খুব সেনসিটিভ্। ঘুম ভেঙে পাশ ফিরতেই দেখলাম রোহিনী পাশে নেই। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দেখলাম দরজাটা খোলা। মনে মনে ভাবলাম সে হয়তো বাথরুমে গেছে, তাই একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন দেখলাম রোহিনী এলো না তখন বাথরুমে গেলাম; কিন্তু সেখানে রোহিনীকে দেখতে পেলাম না। তখন আমি বাইরে এসে গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে রোহিনীকে ডাকতে আরম্ভ করলাম, কিন্তু কোনো সাড়া পেলাম না। বাধ্য হয়ে টর্চ হাতে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলাম গেটে যথারীতি তালা লাগানো রয়েছে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ইতিকর্তব্য ঠিক করছি, এমন সময় কানে ভেসে এলো একটা মচ্ মচ্ শব্দ, শব্দটা আসছে বাগানের দিক থেকে। শুকনো পাতার উপর কেউ যেন হেঁটে চলেছে। আমি শব্দটা অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম বাগানের দিকে, তারপর গাছের আড়াল থেকে যা দেখলাম তাতে শিড়দাঁড়া বেয়ে একটা বরফের স্রোত বয়ে যেতে লাগলো। দেখলাম- একটা ছায়ামূর্তি হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছে জলের দিকে। আমি চিৎকার করে রোহিনী, রোহিনী বলে ডাকতেই সেই ছায়ামূর্তি আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো- ও!কি ভয়ংকর! চোখদুটো থেকে একটা লালরশ্মি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে আর মুখটা হাঁ করতেই দেখলাম দু’টো বীভৎস শ্বদন্ত। আমি যেন কিছুক্ষণ মোহাচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানেই।তারপর সেই ছায়ামূর্তি আবার মুখ ফিরিয়ে হাঁটতে লাগলো এবং একসময় মিশে গেলো পুকুরের কালো জলে। কিন্তু রোহিনীর কোনো খোঁজই পেলাম না সেখানে। সেখান থেকে এলাম দেউরির কাছে রামদিনের ঘরে, রামদিনকে সমস্ত ব্যাপারটা খুলে বলতেই রামদিন যা বললো তার মর্মার্থ হলো- ওটা নাকি প্রেতাত্মা প্রতি মঙ্গলবার ও শনিবার রাতে বাগানে ঘুরে বেড়ায়, তারপর পুকুরের জলে মিলিয়ে যায়।” এই পর্যন্ত বলে রূপেন একটু থামলো।
আমি বললাম, “তারপর রোহিনীকে পেলি কোথায়?”
রূপেন আবার বলতে শুরু করলো, “ঐ পুকুরের পাড়ে একটা তেঁতুল গাছের নীচে অচেতন অবস্থায়। ওখান থেকে তুলে নিয়ে আসা হলো বেডরুমে মোটামুটি আধঘণ্টা শুশ্রূষার পর রোহিনীর জ্ঞান ফিরে এলো কিন্তু ও কোনো কিছুই বলতে পারল না, অর্থাৎ কেমন করে সে ঐ তেঁতুল গাছের নীচে পৌছালো তারপর কি হলো ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই থেকে রোহিনীর মধ্যে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি। মাঝে মাঝে ওকে অনেক রাতে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কথাও বলতে শুনেছি।”
আমি বললাম, “তুই এখানে আর আছিস কতদিন?”
রূপেন বললো, “আছি আরো দশদিন মতো, কিন্তু কেন বল তো?”
আমি ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম ,”তার মানে এই দশদিনের মধ্যেই কাজ হাসিল করতে হবে।”
“কাজ হাসিল মা–নে?ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না?” রূপেন আমার মুখের দিকে চেয়ে বললো।
আমি বললাম, “ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দিতে হবে। তার জন্য কিছু বাস্তুযাগের গুপ্ত কাজ করতে হবে। তবে তার আগে জানতে হবে ঐ প্রেতাত্মার উৎস কোথায়? এটা জানতে হলে আমাকে এখানেই থাকতে হবে কিছুদিন।অবশ্য কাল আমি একবার আমার তন্ত্রমন্ত্রের পুঁথি ও কিছু দ্রব্য নিয়ে আসবো আমার বাড়ি থেকে, কি রাজি আছিস তো?”
রূপেন খুশি হয়ে বললো, “একশোবার!হাজারবার!–কিন্তু তুই কাজটা উদ্ধার করতে পারবি তো ভাই?”
আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, “দেখেই নে না এই বাদল সেন কি পারে আর কি পারে না? আর একটা কথা তোকে বলবো, ভয় পাবি না তো?”
রূপেন বললো, “না না,বল কি বলবি।”
আমি বললাম যে ঐ প্রেতাত্মা তার স্ত্রী রোহিনীর উপর ভর করেছে এবং সেদিন ঐ প্রেতাত্মাই রোহিনীকে সম্মোহিত করে নিয়ে গিয়েছিল বাগানের মধ্যে। সে রোহিনীকে দিয়ে তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চায়–এবং যদি ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দেওয়া না যায় তাহলে ওর স্ত্রীকে ঐ প্রেতাত্মা মেরে ফেলবে এবং গোটা বাড়িটা অধিকার করে বসবে তখন কারো সাধ্য নেই যে এ বাড়িতে একরাত বাস করে। ঘটনাটা জেনে রূপেনের চোখ একদম কপালে উঠলো।
আমি বললাম, “রূপেন তোদের বংশের নিশ্চয় কোনো গোপন ইতিহাস আছে যা তোর পক্ষে জানা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সেই ইতিহাস আমাকে জানতেই হবে। আচ্ছা তোদের লাইব্রেরি রুমটা কোনদিকে, ওটা একবার খুলতে হবে।”
রূপেন বললো, “আরে, ওটা তো আজ দীর্ঘকাল ধরে তালাবন্ধ, উইপোকাতেই অর্ধেক সাবার করে দিয়েছে মনে হয়।”
“তবুও খুলতে হবে আমার মনে হচ্ছে
ওখানেই লুকিয়ে রয়েছে আসল রহস্য।” আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম।
যাইহোক খাওয়া দাওয়া সেরে সেই রাতে ড্রয়িং রুমে নরম গদি আঁটা সোফায় শুয়ে দিব্যি কেটে গেলো।
পরেরদিন বিকালে আমি আমার জ্যোতিষির থলে ও পুঁথি নিয়ে হাজির হয়ে গেলাম চৌধুরী বাড়িতে। রূপেন দেখলাম লনে পাইচারি করছে আমাকে গেট ঠেলে ঢুকতে দেখেই বলে উঠলো,”লাইব্রেরী খোলা হয়েছে, চলো এখনই একবার ঘুরে আসা যাক সেখান থেকে।”
আমি রূপেনের কথায় রাজি হয়ে গেলাম এবং লাইব্রেরী রুমের দিকে পা বাড়ালাম দু’জনে। লাইব্রেরী রুমে ঢুকে রূপেন বললো, “দাঁড়াও, আমি একটা লাইট নিয়ে আসি।” বলেই রূপেন চলে গেলো সেখান থেকে।
আমি ততক্ষণে আমার ব্যাগ থেকে ছোটো চার্জার টর্চটা বের করে লাইব্রেরির এদিক সেদিক দেখতে লাগলাম। তবে রূপেনের অনুমানটা সত্য নয় অর্থাৎ উইপোকার চিহ্নমাত্র পাওয়া গেলো না,পরিবর্তে দেখলাম মাকড়সার রাজ্য আর অসংখ্য টিকটিকি।হঠাৎ আমার চোখ পড়লো এক লালচামড়ায় বাঁধানো মোটা ডায়েরীর দিকে, ডায়েরীটা ধুলো ঝেড়ে ভরলাম ব্যাগের ভেতর। হঠাৎ রূপেন এসে হাজির হলো লাইট হাতে–আলোতে দেখলাম লাইব্রেরিতে দেশী বিদেশী অসংখ্য দামী বইয়ের সম্ভার। বইগুলো মোটামুটি খুলে দেখলাম তাতে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সংগীতের সম্ভার যেমন রয়েছে, তেমনই চোখে পড়লো তন্ত্র মন্ত্রের বইয়ের সম্ভারও। একটা কোণে একটা পিতলে বাঁধানো ছড়ি চোখে পড়তেই রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম,”রূপেন ঐ ছড়িটা কার?”
রূপেন বললো,”আমাদের একজন পুর্বপুরুষের যার নাম নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরী, প্রচণ্ড অত্যাচারী ছিলেন শুনেছি বাবার মুখে।তার মৃত্যুর পর থেকেই জমিদারীর মন্দা অবস্থা দেখা দেয় আর অস্বাভাবিক সব মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকে–যা তোকে আগেই বলেছি।”
আমি এবং রূপেন লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।
রূপেন হাঁক পাড়লো,”রা—ম—দি—ন ঘর টায় তালা লাগাও।”
রামদিন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে দরজায় তালা লাগিয়ে আবার নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আমরা ততক্ষণে দোতালার সিঁড়ি বেয়ে ব্যালকনিতে পৌঁছে গেছি। রূপেন ভেতরে কি যেন দরকারে ঢুকে পড়লো আর আমি আসন্ন সন্ধ্যার রহস্যময়ী রূপ উপলব্ধি করতে লাগলাম। চারদিকে যেন পরীরানীরা তাদের ইন্দ্রজাল বিস্তার করেছে। বাগানের গাছে গাছে পাখিদের কলকাকলিতে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠছে। আমি মোহাবিষ্টের মতো চেয়ে রইলাম সেইদিকেই।
সেদিন ছিলো মঙ্গলবার, রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমি রূপেনকে বললাম, “আজ তো মঙ্গলবার, আজ রাত ১২টার পর আমি বাগানে যাবো।” রূপেন আমার কথা শুনে মনে হলো একটু আতঙ্কিত হয়েছে।
রূপেন কি যেন একবার ভেবে নিয়ে বললো, “বাদল তুই যাস না ওটা প্রেতাত্মা, শুনেছি প্রেতাত্মারা বহুরূপী হয় তোকে যদি কোনো জন্তু হয়ে আক্রমণ করে- তখন?”
আমি বললাম, “পারবে না ব্রাদার পারবে না, আমি এতো কাঁচা খিলাড়ী নই।” রূপেন আর কিছু বললো না। আমি রূপেনেরর সঙ্গে ড্রয়িংরুমে এসে সোফায় বসে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর রূপেন তার বেড রুমে চলে যেতেই আমি ব্যাগ থেকে সেই ডায়েরীখানা বের করে ঘাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ ডায়েরীর একটা পাতায় আমার চোখ দু’টো আটকে গেলো। দেখলাম একটা ধাঁধা জাতীয় কিছু লেখা রয়েছে, ধাঁধাটা এইরকম- “দামিনী চমকে ঘরের আলোকে, জাগায় তৃষ্ণা মনে পাপ।
নিভলো দামিনী সকলই হারায়ে- রেখে গেলো এক মহাশাপ।”এটা নিছকই কোনো আবেগ তাড়িত কবিমনের প্রলাপ, না কৃত কোনো পাপের অনুশোচনার প্রকাশ! ভাবতে লাগলাম গভীরভাবে, ভাবনার মধ্যে এতটাই ডুবে ছিলাম যে বুঝতেই পারিনি রূপেন কখন এসে ঘরে প্রবেশ করেছে- “কিরে বাদল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিস নাকি?”রূপেনের কথাতেই আমি যেন সম্বিৎ ফিরে পেলাম।
আমি বললাম, “না রে, আমি এতক্ষণ একটা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলাম।”
রূপেন কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,”কি ব্যাপারে বলতো?”
আমি বললাম, “দামিনী কে? তুই জানিস এই দামিনী সম্বন্ধে কিছু?”
রূপেন যেন আকাশ থেকে পড়লো, আমি তখন ডাইরীটা খুলে ওকে ধাঁধাটা দেখালাম।ধাঁধাটা দেখে রূপেন হো হো করে হেসে উঠে বললো, “ওটা নিছকই একটা কবিতার লাইন।”
আমি রূপেনের হাসি থামিয়ে বললাম, “না ওটা নিছকই একটা কবিতার লাইন হতে পারেনা কারণ প্রতিটি লাইনকে লাল কালি দিয়ে আন্ডার লাইন করা আছে, এর অর্থ একটাই যে এই কয়টি লাইনের অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
রূপেনের মুখের হাবভাব হঠাৎই যেন কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো, সে বললো, “তাহলে ওটা কি কোনো ধাঁধা, যার উত্তর আমাদের অনুমানের বাইরে।”
“ঠিক তাই।” আমি একটু ভেবে বললাম।
রূপেন বললো, “তাহলে এখন কি করা যাবে?”
আমি রূপেনকে বললাম, “আমার মনে হচ্ছে এই ধাঁধার অর্থের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে বিরাট একটা গুপ্ত ইতিহাস, যে করেই হোক আমাদের জানতেই হবে। কিন্তু কি করে–!কি–ন–তু! পেয়েছি।”
রূপেন বললো,”কি পেয়েছিস্ ?”
আমি ওর কৌতূহল নিরসন করার জন্য বললাম, “এই ধাঁধার উত্তর পাওয়ার উপায়..এখন একমাত্র উপায় হচ্ছে নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মাকে প্ল্যানচেটের মাধ্যমে আমাদের ডেকে আনতে হবে।”
রূপেন খানিকটা অবাক হয়ে বললো, “কিন্তু নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মাকেই কেন?অন্য কেউও তো হতে পারে!”
আমি গম্ভীর গলায় কিন্তু জোরের সঙ্গে বললাম, “না, হতে পারে না, কারণ ঐ লাইন কয়টির নীচে যার স্বাক্ষর দেখলাম তিনি নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীই।”
ওয়ালক্লকটা ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে জানিয়ে দিলো সন্ধ্যা সাতটা- ঠাকুরবাড়ির কাঁসর ঘন্টার আওয়াজ শোনা গেলো। আমি হঠাৎ রূপেনকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা রাঁধুনি দিদির বাড়ি কোথায়?”
রূপেন বললো, “আরে পলাশের দিদিকে চিনিস না?”
আমি বললাম, “ও পলাশের দিদি মানে ছায়াদি,তাই বল। আমি ভেবেছিলাম হয়তো কোলকাতা থেকে লোক সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছি।”
রূপেন বললো, “ঐ তো ছায়াদি রান্নার কাজ সেড়ে বাড়ি যাচ্ছে।” বলেই হাঁক পাড়লো, “ও–ও ছা–য়া–দি এদিকে একবারটি এসো।” বলতে বলতেই ছায়াদি মানে ঘোষ পাড়ার ছায়া ঘোষ একমুখ হেসে বললো, “কি হলো গো দাদাবাবু?” তারপর আমাকে দেখেই বললো, “ও মা বাদলভাই তুমি এখানে? তা কি মনে করে?”
আমি বললাম,”এই একটা বিশেষ কাজে এসেছি দিদি।।”
হঠাৎ রোহিনী রূপেনকে ব্যালকনি থেকে ডাকলে রূপেন বললো, “তুই ছায়াদির সঙ্গে কথা বল আমি একটু আসি।” বলেই চলে গেলো।
ছায়াদি রূপেনের গমনপথের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ, তারপর চাপা গলায় আমাকে বললো, “বাদলভাই এ বাড়িতে ভুত আছে গো–ভুত!”
আমি বললাম, “তুমি দেখেছো?”
সে বললো, “দেখি নাই! তবে সে যে এ বাড়িতেই থাকে তা বেশ বুঝেছি।” এর জন্য সে যে মনে মনে শঙ্কিত তা তার চোখমুখ দেখেই বুঝলাম, তবুও পেটের দায়েই তাকে এ কাজ করতে হয়।
ছায়াদির কাছ থেকে আরও অনেক অদ্ভুত ঘটনার কথাও জানা গেলো। আমি ছায়াদিকে বললাম, “ছায়াদি তুমি এবার এসো অনেক দেরী হয়ে গেলো তোমার।”
ছায়াদি খানিকটা ইতস্ততঃ করেই পা বাড়ালো গেটের দিকে। আমিও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম বারান্দার দিকে। এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলাম দোতালার ব্যালকনিতে এবং একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লাম।কিছুক্ষণ পর সেখানে এসে হাজির হলো রোহিনী ও রূপেন, রোহিনীর হাতে চায়ের ট্রে রূপেন একটা চেয়ার টেনে নিয়ে আমার পাশেই বসলো। রোহিনী আমাদের দু’জনের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজেও একটা কাপে চুমুক দিতে দিতে একটা চেয়ারে বসলো। কিছুক্ষণ একদম নিস্তব্ধ চায়ের চুমুকের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিলো না কারোরই। রোহিনীই নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠলো,”আচ্ছা বাদলবাবু আপনি ভুতে বিশ্বাস করেন?”
আমি বললাম, “বিশ্বাস করা বা না করার মধ্যে ভৌতিক অস্তিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।মৃত্যুর পর আত্মা যে এক অতীন্দ্রিয় জগতে প্রবেশ করে–তা আমি বিশ্বাস করি। এ জগতের সমস্ত কিছুই অলৌকিক যার লৌকিক ব্যাখ্যা সম্ভব নয়।”
রূপেন বলে উঠলো, “ভুত বলে একটা কিছু আছেই।”
রোহিনী হো হো করে হেসে উঠে বললো, “তুমিও শেষে-? ছিঃছিঃ তোমার শিক্ষা দীক্ষায় ধিক্! তুমি না বিজ্ঞানের একজন ভালো স্কলার?”
আমি বললাম, “রোহিনী দেবী রূপেনের কথাটা ঐ ভাবে উড়িয়ে দেবেন না। রূপেন যা বলছে তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য।”
রোহিনী বলে উঠলো, “আমি কোলকাতার মেয়ে আমার বাবা বিখ্যাত বোটানিস্ট ডঃ নিরোদ বরণ ঘোষ, আমরা ছোটো থেকেই একটা বৈজ্ঞানিক পরিবেশে বড় হয়েছি।আমি নিজেও কেমিস্ট্রিতে এম.এস.সি করে গোয়ার একটা অন্য কলেজে পড়াই, তাই এই সব ভুতটুত মেনে নেওয়া আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।”
আমি বললাম, “জানেন সেদিন আপনাকে নিশিভুতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল?”
রোহিনীর মুখে এবার যেন একটা ক্ষীণ ভয়ের আস্তরণ চোখে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িতে রাত্রি আটটার ঘন্টা পড়লো, দূরে কোথাও একটা শিয়াল ডেকে উঠলো- “হুক্কিহুয়া-উয়া–উয়া–উয়া!”।
রোহিনী প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে রূপেনকে উদ্দেশ্য করে বললো,”ঘড়িতে আটটা বাজছে বাদলবাবুকে নিয়ে ডাইনিং প্লেসে এসো।”
রাতের খাওয়া শেষ করে আমি এবং রূপেন ড্রয়িং রূমে বসে সিগারেট খেতে খেতে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম। রূপেন বললো,”রাতে যেন বাগানে যাস না ভাই এটা আমার অনুরোধ।”
আমি আমার ভেতরের অদম্য ইচ্ছা গোপন করে বললাম,”না,না বাগানে আমি যাচ্ছি না।সে তোর কোনো চিন্তা নাই।”রূপেন আশ্বস্ত হয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে ওর বেডরুমে চলে গেলো।
আমিও দরজা বন্ধ করে নাইটল্যাম্পটা জ্বালিয়ে শুয়ে পড়লাম সোফার উপর। রাত তখন বড়জোড় ৯টা হবে। একটা চিন্তার মেঘ আমার মনের মধ্যে ক্রমশ জমে উঠতে লাগলো। ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা বলতে পারবো না, হঠাৎ একটা অদ্ভূত শব্দে ঘুমটা আমার ভেঙে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম রাত ১টা। শব্দটার উৎস সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়লাম, আস্তে আস্তে দরজা খুলে টর্চ হাতে বেরিয়ে এলাম বারান্দায়। এখান থেকে যতদূর চোখ যায় তাতে কিছুই দেখতে পাওয়া গেলো না। এবার আমি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গাড়িবারান্দা ছাড়িয়ে এসে দাঁড়ালাম বাগানের রেলিং দেওয়া দরজার সামনে।একবার ভালো করে বুক পকেট পরীক্ষা করে দেখে নিলাম রূপোর তৈরী ভবাণীযন্ত্রমটা আছে কিনা! তারপর গেট খুলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সেই বিতর্কিত পুকুরটির দিকে, একসময় পেছনে ফিরে দেখলাম বাড়ির দোতালার চিলেকোঠাটা শুধু দৈত্যের মাথার মতো কালো হয়ে আছে।অর্থাৎ বাগানের এই পুকুরটা বাড়িটা থেকে প্রায় দেড়শো থেকে দুশো মিটার দূরে। আজ মঙ্গলবার অতএব সেই প্রেতাত্মা নিশ্চয় আজ বেরিয়ে আসবে। এইসব যখন ভাবছি হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো পুকুরের জলে।আমি একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর যা দেখলাম তাতে আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে হয়ত ভিরমি খেতো।
দেখলাম পুকুরের জলের উপর থেকে বাঁধানো ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে একটা স্যিলুয়েট্ মূর্তি। ধীরে ধীরে সেই মূর্তি ঘাটের উপর উঠে এলো। এরপর যেন মনে হলো সে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে ভালো ভাবে দেখলো।
তারপর আবার এগিয়ে যেতে লাগলো বাড়ির দিকে। আমিও গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে পিছু পিছু হাঁটতে লাগলাম, একসময় সেই সিলুয়েট মূর্তি বাগানের গেটের কাছে পৌঁছেই পিছন ফিরে তাকাতেই চোখ পড়লো আমার দিকে তারপর যে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটলো তাতে আমার সাড়া শরীর এক অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলো।
হঠাৎ একটা একটানা খ্যানখ্যানে অট্টহাসিতে সমস্ত বাগানটা যেন ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলো–কোথা থেকে একটা দমকা বাতাস এসে গাছগুলোকে যেন উপড়ে ফেলতে চাইলো।যেন পৃথিবীর গভীর তলদেশে শুরু হয়েছে বিধ্বংসী কোনো এক কম্পন। চারদিকে একটা অলৌকিক মোহগ্রস্ততা। কতক্ষণ যে এমনভাবে কাটলো তা বলতে পারবো না–হঠাৎ দেখি সেই ছায়ামূর্তির মধ্যে থেকে বেরিয়ে এলো একটা নারীমূর্তি তারপর সেটা নরকঙ্কালে পরিণত হয়ে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে লাগলো আমার দিকে, আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলাম বাড়িটার দিকে কিন্তু কিসে যেন একটা হোঁচট খেয়েই পড়ে গেলাম। এবার সেই নরকঙ্কাল দেখলাম আমার প্রায় খুব কাছে হাঁটু মুড়ে বসেছে আর তার দুই হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলেছে আমার পা দু’টো।আমি বেশ বুঝতে পারলাম সে আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে পুকুরের দিকে। নিশ্চিত মৃত্যু, সে আমাকে জলে ডুবিয়ে মেরে ফেলবে। মুহূর্তের মধ্যে মনে পড়ে গেলো ভবাণীযন্ত্রমের কথা- প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পকেট থেকে বার করে আনলাম সেটা। দেখলাম সেই নরকঙ্কাল আমার পা দু’টো ছেড়ে বেশ খানিকটা দূরে পুকুরের জলের ধারে দাঁড়িয়ে হেসে চলেছে সেই পৈশাচিক হাড়হিম করা হাসি,”হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ-হিঁ।”
ভবাণীযন্ত্রম তুলে ধরতেই সেটা মিলিয়ে গেলো কালো জলে একটা বিকট শব্দ করে।
আমার সাড়া শরীর যেন অবসন্ন হয়ে আসতে লাগলো আনিমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর মতো। বুঝতে পারলাম আজ ভবাণীযন্ত্রমের জন্যই বেঁচে গেলাম। ধীরে ধীরে সবার অলক্ষ্যে আবার ফিরে এলাম ড্রয়িংরুমে কিন্তু সারারাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারলাম না।
পরেরদিন সকালে ব্রাশ করে ব্যালকনিতে চা খেতে খেতে রূপেন বললো,”কি রে বাগানে যাসনি তো?”
আমি গতরাত্রির ঘটনা বেমালুম চেপে গিয়ে বললাম,”পাগল হয়েছিস, জেনে শুনে কেউ ভুতের খপ্পরে পড়তে চায়, কাল নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়েছি।”
রোহিনী আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠে বললো, “আ্যলজেলাম্ খেয়েছিলেন নাকি?”
আমি মৃদু হেসে বললাম, “তার দরকার হবে না ভাবীজি, নিদ্রাদেবী আমার উপর সদাপ্রসন্না।”
কথাটা শোনামাত্র ওদের মধ্যে একটা হালকা হাসির তরঙ্গ বয়ে গেলো যেন।
রোহিনীর মুখটা যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে- এ যেন আ্যনিমিক টেনডেনসি বলেই মনে হতে লাগলো আমার। রোহিনী এমনিতে যে খুব প্রাণোচ্ছল তা এই দু’দিনে বেশ বুঝতে পারলাম। ওর অজান্তে কোনো এক বিদেহী আত্মা ওর শরীর থেকে এক্টোপ্লাজমকে আশ্রয় করে সক্রিয় হয়ে উঠছে এবং একটা দুর্নিবার অশরীরী আকর্ষণ ওর শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে চলেছে। এভাবে চলতে থাকলে ওকে বাঁচানো সম্ভব নয়।
আমি কেবলমাত্র রোহিনীর কথা ভেবেই সেইদিন রাত্রেই খাওয়া দাওয়ার পর প্ল্যানচেটে বসার সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করলাম। ড্রয়িং রূমের দরজা জানালা বন্ধ করে একটা তেপায়া টেবিলের সামনে মুখোমুখি বসে পড়লাম তিনজনে। ঘড়ি ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে জানিয়ে দিলো- রাত এগারটা। সমস্ত ঘরটা অন্ধকার, কেবলমাত্র টেবিলের উপর জ্বলছে একখানা মোমবাতি।আমি, রূপেন ও রোহিনী তিনজনে আঙ্গুলে আঙ্গুল ঠেকিয়ে নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর ছবি মনে মনে চিন্তা করতে লাগলাম- চারদিকে জমাট নিস্তব্ধতা যেন সারা বাড়িটাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। হঠাৎ দরজাটা নড়ে উঠলো কেউ যেন নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করলো- সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম রূপেনের চোখমুখ কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। চোখদু’টো টকটকে লাল আর বিকৃত মুখ দিয়ে লালা ঝরছে- হঠাৎ রুমের ভেতর গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বরে রূপেন বলে উঠলো,”আ-মা-য়—কে-ন–ডা-ক-লি–ব-ল?”
আমি বুঝতে পারলাম রূপেনের দেহ আশ্রয় করেছে নৃসিংহ প্রসাদের আত্মা এ কন্ঠস্বর রূপেনের নয় এটা নৃসিংহ প্রসাদ চৌধুরীর আত্মার পৈশাচিক কন্ঠস্বর- কি বীভৎস সেই কন্ঠস্বর মনে হলো যেন কোনো গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক জান্তব গর্জন।রোহিনী ভয়ে আমাকে চেপে ধরলো,আমি ইশারায় তাকে সাহস দিলাম। এবার আমি বললাম,”বলুন কে আপনি?”
সেই আত্মা চিৎকার করে বলে উঠলো,”তু-ই—যা-কে–ডে-কে-ছি-স্—সে-ই-ই—আ-আ-মি——আ-মা-র—–খু-ব—ক-ষ্ট—হ–চ্ছে—ব-ল–কি– ব–ল–বি ব-ল?”
আমি নির্ভয়ে বললাম, “আপনি যার দেহে এখন অবস্থান করছেন সে আপনারই বংশধর–অতএব এর জীবন ও সুখ-সমৃদ্ধি রক্ষা করতে আপনাকে আমাদের সাহায্য করতেই হবে।”
আবার সেই আত্মা বলে উঠলো,”ব-ল—কি–প্র-য়ো-জ–নে—আ–মা–কে–ডা-ক-লি—আ-মি–বে–শী ক্ষ-ণ—থা-ক–তে—পা–র-ব–না—আ-মা-র—ক-ষ্ট—হ-চ্ছে।”
আমি আবার বললাম, “আর একটু কষ্ট করে বসুন- আমি একটি ধাঁধা বলছি তার উত্তর আপনাকে বলে যেতে হবে- দামিনী চমকে ঘরের আলোকে, জাগায় তৃষ্ণা মনে পাপ।
নিভলো দামিনী সকলই হারায়ে–রেখে গেলো এক মহাশাপ—–এর অর্থ কি? আজ আপনাকে বলে যেতেই হবে, তা নাহলে আপনার এই বংশধরের মহাবিপদ।”
সঙ্গে সঙ্গে সেই আত্মা হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,”দা–মি–নী-হ-লো–এ-ক-জ-ন —বা-ই-জী।ও-র –রূ-পে —মু-গ্ধ হ-য়ে—-আ-মি—ও-কে—ভো-গ —ক-রি–এ-ব-ং—ব-দ-না-মে-র—ভ-য়ে—খু-ন— ক-রে– ফে-লি–এ-ব-ং—তা-র–লা-শ—ঐ—পু-কু-রে-র—পাঁ-কে—পুঁ-তে—ফে-লে-ছিলা-ম—-মৃ-ত্যু-র—আ-গে—সে—ব-লে-ছি-লো—এ-ই—বং-শে-র–উ-ত্তর—পুরু-ষ—সক-ল-কে—সে–মে-রে–ফে-ল-বে–মে-রে —ফেল-বে–কে-উ—বাঁচ-বে—না—ও-র—আ-ত্মা—শা-ন্তি—পা-ই নি—-শা-ন্-তি—-পা–ই–নি—–এ-বা-র—–আ–মা–য়–
–ড়ে–দে—আ-মায়—এ-বা-র–ছে–ড়ে –দে-দে–দে।”
আমি চিৎকার করে বললাম, “আপনি চলে যান- আপনার বংশধরের দেহ থেকে এবার আপনি চলে যান–চলে যান।”
সঙ্গে সঙ্গে একটা দমকা বাতাসে জানালা গুলো খুলে যেতেই মনে হলো ঘর থেকে একটা ছায়া যেন বাইরের জমাট অন্ধকারে মিশিয়ে গেলো। রূপেন জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝের উপর। ওকে আমি তুলে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলাম বেডরুমে খাটের উপর বিছানায়। তারপর ওর চোখে মুখে মন্ত্রপুত জলের ছিটে দিতেই ও আস্তে আস্তে চোখ খুললো বটে কিন্তু কথা বলতে পারলো না।ইশারা করে জল খেতে চাইলে আমি রোহিনীকে একটু গরম দুধ আনতে বললাম।রোহিনী দুধ নিয়ে এলে ওকে একটু একটু করে দুধ দিলাম মুখে। প্রায় ঘন্টা খানেক কেটে গেলো ঐ ভাবেই, তারপর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমার হাতটা চেপে ধরেছে। আমি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলাম,”কি রে কিছু বলবি।”
ও ধীরে ধীরে বললো,”রোহিনী কোথায়?”
রোহিনী পাশেই দাঁড়িয়েছিলো বললো, ‘এই তো আমি, কোনো ভয় নেই সব ঠিক আছে।” মনে হলো ও যেন একটু হাসার চেষ্টা করলো।রোহিনীকে আমি শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলাম।
পরেরদিন সকালে চায়ের আসরে রূপেন বললো, “এখন তাহলে আমাদের করণীয় কি?”
রোহিনী বললো, “সে তোমাকে ভাবতে হবে না, বাদলবাবু সব ব্যবস্থা ভেবেরছেন।”
আমি বললাম “চিন্তা নেই, এই শনিবার রাতেই হোম করবো ঐ পুকুরের বাঁধানো ঘাটে এবং ঐ প্রেতাত্মাকে মুক্তি দেবো তন্ত্রমতে। তার জন্য যা যা দরকার আমি লিস্ট করে রেখেছি রামদিনকে দিয়ে জিনিসগুলো আনিয়ে নিতে হবে। সেদিন ওখানে রামদিনও থাকবে আমাদের সঙ্গে।”
রূপেন ও রোহিনীর চোখমুখ দেখে মনে হলো তারা যেন দীর্ঘদিনের একটা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে চলেছে। রূপেন রামদিনকে ডেকে তার হাতে লিস্ট ও একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললো, “আজই এই জিনিসগুলো তার বাঙলার বাজারে গণেশ ভান্ডার থেকে নিয়ে এসো।”
রামদিন জি হুজুর বলে বিদায় নিলে রূপেন আমাকে বললো, “ভাগ্যিস সেদিন তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিলো, তা নাহলে কি যে হতো!”
আমি বললাম, “সত্যিই তাই। আসলে কি জানিস রাখে হরি তো মারে কে–আর মারে হরি তো রাখে কে!”
দেখতে দেখতে দু’টো দিন কেটে গেলো।আজই শনিবার। সকাল থেকেই আমরা তিনজনে মানসিক ভাবে হোমের জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলাম। হোম শুরু হবে ঠিক রাত দশটায়- সেখানে থাকবো আমি, রূপেন, রোহিনী ও রামদিন। দিনে শুধু চা আর জল ছাড়া কিছুই খাওয়া যাবেনা, কারণ তিনজনকেই উপবাসে থাকতে হবে, এমনকি রামদিনকেও। রামদিনকে উপবাসের কথা আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি, রূপেন ও রোহিনী বাড়ির লনে পড়ন্ত রোদে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে গল্পগুজবে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে দিলাম, তারই মাঝখানে রোহিনী আমাদের জন্য চা করে নিয়ে এলো। আমরা চা খেয়ে উঠে গেলাম বাড়ির ভেতরে।রোহিনী দেখলাম কিচেনে গেলো। মনে হয় ছায়াদিকে সাহায্য করতে, কারণ রাত্রে হোম শেষ করে নিরামিষ আহার গ্রহণই বিধেয়, তাই ছায়াদির সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে হয়তো লুচি ও নিরামিষ কোনো পদ বানিয়ে নেবে রাতের জন্য।
রাত ঠিক সাড়ে নটায় সকলে জিনিস পত্র নিয়ে পৌঁছে গেলাম পুকুরের বাঁধানো ঘাটে।আমি মন্ত্র পড়ে সকলের গাত্রবন্ধন করলাম, আর গলায় পড়ে নিলাম রুদ্রাক্ষের মালা ও ভবাণীযন্ত্রম। দু’টো বড় চার্জার লাইট জ্বালিয়ে দেওয়া হলো। আমি হোমের নিমিত্ত স্থন্ডিল প্রস্তুত করে কুশাসনে বসে পড়লাম বাকিরা অর্থাৎ রূপেন ,রোহিনী ও রামদিন বসে রইলো আমার কিছুটা পেছনে। আমি অশ্বত্থ কাঠ সাজিয়ে কুশ দ্বারা মন্ত্রপাঠ পুর্ব্বক অগ্নি সংযোগ করতেই যোগাগ্নি জ্বলে উঠলো। আমি সর্ব্বদেবদেবীকে একে একে মন্ত্রপাঠ করতে করতে ঘৃতাহুতি দিতে লাগলাম এবং যোগাগ্নিতে সমীধ যোগাতে লাগলাম কখনো সমন্ত্রক কখনবা অমন্ত্রক।একসময় পূর্ণাহুতির সময় এগিয়ে এলো আর ঠিক তখনই ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা! হঠাৎ রোহিনী চিৎকার করে খ্যানখ্যানে গলায় বলে উঠলো,”আঁমায় ছেঁড়ে দেঁ রেঁ আঁগুনেঁ পূঁড়িয়েঁ মাঁরিস নাঁ। ছেঁড়ে দেঁ, ছেঁড়ে দেঁ।” বলতে বলতে রোহিনী জলের দিকে দৌড়ে যেতে গেলে রামদিন ও রূপেন তাকে ধরে ফেললো। আর ঠিক তখনই পুকুরের মাঝখানে আভির্ভাব ঘটলো এক ছায়ামূর্তির তার অট্টহাসিতে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠলো- হঠাৎ একটা দমকা বাতাস সবকিছু যেন লন্ডভন্ড করে দিতে চাইলো- আমি আর দেরী না করে মন্ত্রপাঠ করে পূর্ণাহুতি দিলাম যোগাগ্নিতে- সঙ্গে সঙ্গে সব আবার আগের মতো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো- আর তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেলো পুকুরের মাঝখানে সেই ছায়ামূর্তিটি আগুনে পুড়তে আরম্ভ করেছে আর খ্যান খ্যানে গলায় বিকট চিৎকার করে চলেছে। দেখতে দেখতে সেই ছায়ামূর্তির মধ্যে থেকে বেড়িয়ে এলো একটা জলন্ত কঙ্কাল সে চিৎকার করে বলতে লাগলো, “আঁর আঁসবো নাঁ এঁখানে, আঁমাঁয় ছেঁড়ে দেঁ—ছেঁড়ে দেঁ—ছেঁড়ে দেঁ।” একসময় সেই নরকঙ্কাল পুড়ে ছাই হয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলীর সাথে মিশে গিয়ে উঠে যেতে লাগলো দূর আকাশে আর তার চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেলো দূরদিগন্তে।
আমি সেই দিকেই তাকিয়ে ছিলাম এতক্ষণ ।হঠাৎ রূপেনের হতাশাভরা কন্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পিছন ফিরে দেখি রোহিনী অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে বাঁধানো ঘাটের উপর– জল থেকে কিছুটা দূরে।
আমি চিৎকার করে বললাম, “আর কোনো ভয় নেই প্রেতাত্মা মুক্তি লাভ করেছে। চলো ওকে তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে।”
রূপেন রোহিনীকে কোলে তুলে নিলো।রামদিন আলো হাতে আমাদের পথ দেখাতে লাগলো- আমরা অবশেষে পৌঁছে গেলাম বাড়ির বারান্দায়। রোহিনীকে সোফার উপর শোয়ানো হলো, আমি তার মুখে মন্ত্রপুত জলের ছিটে দিতেই সে চোখ খুললো। আমি, রূপেন ও রামদিন সেখানেই আরোও ঘন্টা খানেক বসে রইলাম- রূপেন রোহিনীর মাথায় হাত বোলাতে লাগলো।আমিও ভবাণীযন্ত্রম রোহিনীর মাথায় ঠেকিয়ে ভবাণীস্ত্রোত্র পাঠ করে দিলাম। কিছুক্ষণ পর দেখলাম রোহিনী ধীরে ধীরে উঠে বসেছে সোফার উপর।এখন আর চোখে মুখে সেই অশুভছায়ার প্রভাব নেই, পায়ের মাংসল অংশের ভেতরেও সেই অশরীরীর স্পর্শ কেটে গেছে। সারাগায়ে লেপ্টে থাকাসেই অশুভছায়ার কুয়াশাও উধাও–এ যেন রোহিনীর নবজন্ম। সেই রাত্রে সকলেই আমরা গরম দুধ খেয়ে কাটালাম।
পরেরদিন যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন ৮টা। আমি ব্রাশট্রাশ করে ফ্রেস হয়ে আমার জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে রোহিনী ও রূপেনের সাথে চায়ের আড্ডায় যোগ দিলাম।গরম গরম লুচি ও আলুর দম সহযোগে প্রাতরাশ সারলাম—এবার আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বললাম,”এবার তো আমায় ছেড়ে দিতে হবে বন্ধু।”
রূপেন বললো,”তোর এই উপকার জীবনেও ভুলবনা ভাই।”
রোহিনী বললো, “চলুন না একবার গোয়ায় মাসখানেক থেকে আসবেন।”
আমি বললাম, “এবারে তা আর সম্ভব নয় ভাবীজি, নেক্সট টাইম চেষ্টা করে দেখবো।”
আমি ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম নীচে, তারপর ধীরে ধীরে গেটের কাছে আসতেই রামদিন আমাকে সেলাম জানালো, ওর চোখে মুখে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ বেশ লক্ষ্য করলাম। একসময় গেট পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম বড়রাস্তার উপর– সেখান থেকে ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম রূপেন ও রোহিনী তখনও দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকনিতে–ওরা যেন এখন শাপমুক্তির আনন্দে বিহ্বল।একসময় দেখলাম চৌধুরী বাড়ির চিলেকোঠাটাও যেন ওদের দু’জনের মতোই আকাশের দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাপমুক্তির আনন্দে শরতের রোদমেখে হালকা একটা বিমূর্ত হাসিতে মাথা দোলাচ্ছে।
——— সমাপ্ত——